ওয়েস আল-করনী (রহঃ): দুনিয়ায় অচেনা, আসমানে প্রিয়
ভূমিকা
ইতিহাসে এমন কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা দুনিয়ার চোখে ছিলেন প্রায় অদৃশ্য, কিন্তু আসমানের দরবারে ছিলেন অত্যন্ত সম্মানিত। তাঁদের নাম উচ্চারিত হলে হৃদয়ে বিনয় জাগে, চোখে আসে অশ্রু, আর ঈমান নতুন করে জেগে ওঠে। ঠিক এমনই একজন মহিমান্বিত চরিত্র হলেন হযরত ওয়েস আল-করনী (রহঃ)—যিনি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে ভালোবেসেছেন প্রাণভরে, অথচ কখনো সরাসরি সাক্ষাৎ করতে পারেননি; তবু নবীজির ﷺ দরবারে যাঁর মর্যাদা ছিল অনন্য।
এই আর্টিকেলে আমরা জানব—ওয়েস আল-করনী (রহঃ)-এর জীবনকথা, তাঁর আত্মত্যাগ, মায়ের প্রতি অসামান্য দায়িত্ববোধ, রাসূল ﷺ–এর সঙ্গে তাঁর আধ্যাত্মিক সম্পর্ক এবং কেন তিনি “দুনিয়ায় অচেনা, আসমানে প্রিয়” হিসেবে পরিচিত।
ওয়েস আল-করনী (রহঃ) কে ছিলেন?
হযরত ওয়েস আল-করনী (রহঃ) ছিলেন ইয়েমেনের ক্বারন অঞ্চলের অধিবাসী। তিনি ছিলেন তাবেঈন—অর্থাৎ সাহাবি নন, কিন্তু সাহাবিদের যুগে বসবাসকারী এক মহান আল্লাহওয়ালা। তাঁর জীবনের সবচেয়ে বিস্ময়কর দিক হলো—তিনি রাসূলুল্লাহ ﷺ–এর যুগে জীবিত থেকেও কখনো তাঁকে সরাসরি দেখেননি।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, রাসূলুল্লাহ ﷺ নিজেই সাহাবিদের কাছে ওয়েস (রহঃ)-এর কথা বলেছেন, তাঁর জন্য দোয়া করতে নির্দেশ দিয়েছেন—যা তাঁর মর্যাদাকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে।
রাসূল ﷺ–এর সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক
হাদিসে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
“তোমাদের কাছে ইয়েমেন থেকে ওয়েস ইবনে আমির নামের এক ব্যক্তি আসবে… সে যদি আল্লাহর নামে শপথ করে, আল্লাহ তা কবুল করেন। তোমরা তাকে পেলে তার কাছে দোয়া চাইবে।”
(সহিহ মুসলিম)
এই হাদিস প্রমাণ করে—ওয়েস আল-করনী (রহঃ) দুনিয়াতে অচেনা হলেও আসমানের দরবারে ছিলেন অত্যন্ত প্রিয়।
ইসলামের শ্রেষ্ঠ তাবেঈনদের জীবনকথা
মায়ের প্রতি অতুলনীয় ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ
ওয়েস আল-করনী (রহঃ)-এর জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল দিক ছিল তাঁর মায়ের প্রতি আনুগত্য। তাঁর মা ছিলেন বৃদ্ধ ও অসুস্থ। রাসূল ﷺ–এর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য ইয়েমেন থেকে মদিনায় যাওয়ার সুযোগ তাঁর সামনে এসেছিল, কিন্তু মায়ের দেখাশোনার দায়িত্ব তাঁকে সে সফর থেকে বিরত রাখে।
তিনি জানতেন—মায়ের সেবা আল্লাহর কাছে কতটা প্রিয়। তাই নিজের ইচ্ছাকে বিসর্জন দিয়ে মায়ের খেদমতকেই অগ্রাধিকার দেন।
এই আত্মত্যাগই তাঁকে আসমানের প্রিয় বানিয়েছে।
ইসলামে মায়ের মর্যাদা ও সন্তানের দায়িত্ব
দুনিয়ার দৃষ্টিতে অচেনা কেন ছিলেন তিনি?
ওয়েস আল-করনী (রহঃ) কখনো খ্যাতি চাননি।
সাধারণ পোশাক
সাধারণ জীবনযাপন
মানুষের প্রশংসা থেকে দূরে থাকা
লোক দেখানো ইবাদত পরিহার
তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেকে আড়ালে রাখতেন। কারণ তাঁর লক্ষ্য ছিল মানুষের প্রশংসা নয়, আল্লাহর সন্তুষ্টি।
আসমানে প্রিয় হওয়ার কারণ
ওয়েস আল-করনী (রহঃ) আসমানে প্রিয় হওয়ার পেছনে কয়েকটি মূল কারণ ছিল:
ইখলাস (খাঁটি নিয়ত)
মায়ের খেদমত
নবী ﷺ–এর প্রতি গভীর ভালোবাসা
দুনিয়ার মোহ থেকে মুক্ত থাকা
অধিক ইবাদত ও দোয়া
এই গুণগুলোই তাঁকে আল্লাহর নিকট বিশেষ মর্যাদায় পৌঁছে দেয়।
সাহাবিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ
হযরত উমর (রাঃ) ও হযরত আলী (রাঃ) রাসূল ﷺ–এর নির্দেশ অনুযায়ী ওয়েস আল-করনী (রহঃ)-কে খুঁজে বের করেন। তাঁরা তাঁর কাছে দোয়া চাইলে ওয়েস (রহঃ) অত্যন্ত লজ্জিত ও বিনয়ী হয়ে পড়েন।
এই দৃশ্য প্রমাণ করে—আল্লাহ কাকে সম্মান দেন, তা দুনিয়ার পরিচয়ের ওপর নির্ভর করে না।
আমাদের জীবনের জন্য শিক্ষা
ওয়েস আল-করনী (রহঃ)-এর জীবন থেকে আমরা যেসব শিক্ষা পাই:
আল্লাহর কাছে পরিচিত হওয়াই আসল সাফল্য
মায়ের দোয়া মানুষের তাকদির বদলে দিতে পারে
নিঃশব্দ আমলও আল্লাহ কবুল করেন
খ্যাতি নয়, ইখলাসই মুক্তির পথ
আধুনিক যুগে ওয়েস আল-করনী (রহঃ)-এর প্রাসঙ্গিকতা
আজকের যুগে আমরা লাইক, ফলোয়ার আর পরিচিতির পেছনে ছুটি। অথচ ওয়েস আল-করনী (রহঃ) আমাদের শেখান—
“মানুষ না চিনলেও আল্লাহ যেন চিনেন।”
এই চিন্তাই একজন মুমিনকে প্রকৃত সফলতায় পৌঁছে দেয়।
উপসংহার
ওয়েস আল-করনী (রহঃ) প্রমাণ করেছেন—
দুনিয়ায় অচেনা থাকা কোনো ব্যর্থতা নয়, যদি আসমানে আপনি প্রিয় হন।
তাঁর জীবন আমাদের শেখায়, নীরব ইবাদত, মায়ের খেদমত এবং খাঁটি নিয়ত মানুষকে এমন উচ্চতায় পৌঁছে দিতে পারে, যেখানে দুনিয়ার কোনো পদমর্যাদা পৌঁছাতে পারে না।
FAQ: ওয়েস আল-করনী (রহঃ) সম্পর্কে সাধারণ প্রশ্ন
❓ ওয়েস আল-করনী (রহঃ) কি সাহাবি ছিলেন?
না, তিনি সাহাবি নন; তিনি ছিলেন একজন তাবেঈ।
❓ তিনি কেন রাসূল ﷺ–এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারেননি?
মায়ের অসুস্থতার কারণে তাঁর খেদমতকে অগ্রাধিকার দেওয়ায় তিনি মদিনায় যেতে পারেননি।
❓ রাসূল ﷺ কি তাঁর প্রশংসা করেছেন?
হ্যাঁ, সহিহ হাদিসে রাসূল ﷺ তাঁর মর্যাদা ও দোয়ার কথা উল্লেখ করেছেন।
❓ তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা কী?
ইখলাস, মায়ের সেবা এবং দুনিয়ার মোহ ত্যাগ।
❓ বর্তমান যুগে তাঁর জীবন থেকে আমরা কী শিখতে পারি?
আল্লাহর সন্তুষ্টিকে জীবনের একমাত্র লক্ষ্য বানানো।
_%E0%A6%A6%E0%A7%81%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A6%BE%E0%A7%9F_%E0%A6%85%E0%A6%9A%E0%A7%87%E0%A6%A8%E0%A6%BE,_%E0%A6%86%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%87_%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A7%9F.jpeg)
Please do not enter any spam link in the comment box. ConversionConversion EmoticonEmoticon