মূসা (আ.)-এর প্রথম ওহি: ফেরাউনের বিরুদ্ধে ঐশী মিশন

 


মূসা_(আ.)_এর_প্রথম_ওহি_ফেরাউনের_বিরুদ্ধে_ঐশী_মিশন

মূসা (আ.)-এর প্রথম ওহি: ফেরাউনের বিরুদ্ধে ঐশী মিশন

Episode 10

ভূমিকা

মানব ইতিহাসে এমন কিছু মুহূর্ত আছে, যা শুধু একটি ব্যক্তির জীবনকেই বদলে দেয় না, বরং একটি জাতি ও সভ্যতার গতিপথ পাল্টে দেয়। হযরত মূসা (আ.)-এর জীবনে প্রথম ওহি প্রাপ্তির মুহূর্তটি তেমনই এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ। সাইনাই অঞ্চলের পবিত্র তূর পাহাড়ে আল্লাহর সরাসরি আহ্বান তাঁকে নবুয়তের দায়িত্বে অভিষিক্ত করে এবং নির্যাতিত বনী ইসরাইল জাতির মুক্তির জন্য এক ঐশী মিশনের সূচনা করে। এই ওহির কেন্দ্রবিন্দু ছিল—ফেরাউনের জুলুমের বিরুদ্ধে সত্য ও ন্যায়ের সংগ্রাম।

এই পর্বে আমরা আলোচনা করব মূসা (আ.)-এর প্রথম ওহির পটভূমি, আল্লাহর নির্দেশ, ফেরাউনের চরিত্র ও অত্যাচার, এবং কীভাবে এই ঐশী মিশন মানবজাতির জন্য এক চিরন্তন শিক্ষায় পরিণত হয়েছে।

মিশরের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট

মূসা (আ.)-এর নবুয়ত প্রাপ্তির সময় মিশর ছিল এক শক্তিশালী সাম্রাজ্য। ফেরাউন নিজেকে দেবতা বলে ঘোষণা করেছিল এবং তার শাসনব্যবস্থা ছিল নিপীড়নমূলক ও শ্রেণিভিত্তিক। বনী ইসরাইল জাতিকে দাসে পরিণত করে তাদের ওপর চালানো হচ্ছিল সীমাহীন নির্যাতন—

  • জোরপূর্বক শ্রম

  • নবজাতক পুত্রসন্তান হত্যা

  • সামাজিক ও ধর্মীয় অধিকার হরণ

এই অবস্থা শুধু রাজনৈতিক অন্যায় ছিল না; এটি ছিল মানবতার বিরুদ্ধে এক ভয়াবহ অপরাধ।

 সাইনাই পাহাড়ে নবুয়ত লাভ—ঐশী আহ্বানের রাত

তূর পাহাড়ে সেই ঐশী মুহূর্ত

মাদইয়ান থেকে ফেরার পথে, এক শীতল রাতে, মূসা (আ.) দূরে আগুনের আলো দেখতে পেলেন। পরিবারকে রেখে তিনি সেই আলোর দিকে এগিয়ে যান। সেখানেই তূর পাহাড়ের পাদদেশে ঘটে যায় ইতিহাসের অন্যতম মহান ঘটনা।

আল্লাহ তাআলা বলেন:

“হে মূসা, আমি তোমার রব। তুমি তোমার জুতা খুলে ফেলো; তুমি পবিত্র উপত্যকা তুওয়ায় অবস্থান করছ।”

এই প্রথম ওহি ছিল শুধু আল্লাহর পরিচয় নয়, বরং একটি দায়িত্বের ঘোষণাও।

নবুয়তের দায়িত্ব ও আল্লাহর নির্দেশ

প্রথম ওহিতেই আল্লাহ মূসা (আ.)-কে একটি সুস্পষ্ট মিশন দেন:

“ফেরাউনের কাছে যাও, সে সীমালঙ্ঘন করেছে।”

এই নির্দেশের মধ্যে ছিল—

  1. আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠা

  2. ফেরাউনের মিথ্যা দেবত্বের প্রতিবাদ

  3. বনী ইসরাইল জাতির মুক্তির দাবি

মূসা (আ.) নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করে বলেন যে তাঁর জিহ্বা জড়তা আছে। তখন আল্লাহ তাঁর ভাই হারুন (আ.)-কে সহকারী হিসেবে নিযুক্ত করেন। এটি প্রমাণ করে—ঐশী মিশনে দলগত সহযোগিতার গুরুত্ব।

 মাদইয়ানে নতুন শুরু—মূসা (আ.)-এর জীবনকথা

অলৌকিক নিদর্শন: লাঠি ও উজ্জ্বল হাত

আল্লাহ মূসা (আ.)-কে দুটি প্রধান মুজিজা দান করেন—

  • লাঠি, যা সাপে পরিণত হতো

  • হাত, যা বগলে রাখলে উজ্জ্বল আলো বিকিরণ করত

এই নিদর্শনগুলো ফেরাউনের দরবারে সত্যের প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপিত হয়। এটি ছিল যুক্তি ও অলৌকিকতার সমন্বিত দাওয়াত।

ফেরাউনের দরবারে সত্যের আহ্বান

মূসা (আ.) ও হারুন (আ.) দৃঢ় কণ্ঠে ফেরাউনকে বলেন:

“আমাদের সঙ্গে বনী ইসরাইলকে ছেড়ে দাও এবং আল্লাহর অবাধ্যতা থেকে ফিরে এসো।”

ফেরাউন অহংকারে অন্ধ হয়ে এই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে। সে মূসা (আ.)-কে জাদুকর বলে আখ্যা দেয় এবং দরবারি জাদুকরদের দিয়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন করে।

সত্য ও মিথ্যার সংঘর্ষ

জাদুকরদের প্রতিযোগিতায় আল্লাহর শক্তির প্রকাশ ঘটে। মূসা (আ.)-এর লাঠি সব জাদুকে গ্রাস করে নেয়। সত্য স্পষ্ট হয়ে যায়। অনেক জাদুকর ঈমান গ্রহণ করে।

ফেরাউন তখন আরও হিংস্র হয়ে ওঠে এবং নির্যাতন বাড়িয়ে দেয়।

 কুরআনুল কারিম, সূরা ত্ব-হা (২০)

ঐশী মিশনের শিক্ষা

এই ঘটনাপ্রবাহ আমাদের শেখায়—

  • সত্য কখনো শক্তির ওপর নির্ভরশীল নয়

  • আল্লাহর সাহায্য ধৈর্যশীলদের সঙ্গে

  • অহংকারের পরিণতি ধ্বংস

মূসা (আ.)-এর প্রথম ওহি আজও আমাদের মনে করিয়ে দেয়—অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোই একজন মুমিনের প্রকৃত দায়িত্ব।

উপসংহার

মূসা (আ.)-এর প্রথম ওহি ছিল মানব ইতিহাসের এক মোড় ঘোরানো অধ্যায়। এটি শুধু নবুয়তের সূচনা নয়; এটি ছিল জুলুমের বিরুদ্ধে আল্লাহর ঘোষিত যুদ্ধ। ফেরাউনের মতো শক্তিশালী শাসকের সামনে দাঁড়িয়ে সত্য উচ্চারণের সাহস আজও আমাদের অনুপ্রেরণা জোগায়।

এই ঐশী মিশনের বার্তা চিরন্তন—যেখানে জুলুম আছে, সেখানে সত্যের আহ্বান থাকবেই।

FAQ (প্রশ্নোত্তর)

প্রশ্ন ১: মূসা (আ.)-এর প্রথম ওহি কোথায় নাজিল হয়?
উত্তর: সাইনাই অঞ্চলের তূর পাহাড়ে, পবিত্র উপত্যকা তুওয়ায়।

প্রশ্ন ২: প্রথম ওহির মূল নির্দেশ কী ছিল?
উত্তর: ফেরাউনের কাছে গিয়ে তাকে আল্লাহর একত্ববাদে আহ্বান করা এবং বনী ইসরাইলকে মুক্ত করার নির্দেশ।

প্রশ্ন ৩: কেন হারুন (আ.)-কে সহকারী করা হয়?
উত্তর: মূসা (আ.)-এর জিহ্বাগত জড়তা ছিল; হারুন (আ.) ছিলেন বাগ্মী ও সহায়ক।

প্রশ্ন ৪: এই ঘটনার প্রধান শিক্ষা কী?
উত্তর: সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকলে আল্লাহর সাহায্য অবশ্যম্ভাবী।

প্রশ্ন ৫: এই কাহিনি আজকের সমাজে কীভাবে প্রাসঙ্গিক?
উত্তর: এটি আমাদের শেখায় ক্ষমতা নয়, ন্যায় ও সত্যই শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয়।

Previous
Next Post »

Please do not enter any spam link in the comment box. ConversionConversion EmoticonEmoticon