মাদইয়ানে নতুন শুরু - হযরত মূসা (আঃ) এর জীবনকথা | পর্ব ৬
ভূমিকা
মিসরের রাজপ্রাসাদের বিলাসিতা ছেড়ে, ফেরাউনের ক্রোধ থেকে পালিয়ে, হযরত মূসা (আঃ) এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়ালেন। তাঁর সামনে ছিল বিস্তীর্ণ মরুভূমি, পেছনে ছিল এক হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ এবং নিশ্চিত মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার পরিকল্পনা ভিন্ন ছিল। মাদইয়ান নগরীতে তাঁর জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হতে চলেছিল - এমন এক অধ্যায় যা তাঁকে প্রস্তুত করবে নবুওয়াতের মহান দায়িত্বের জন্য। এই পর্বে আমরা জানব মাদইয়ানে মূসা (আঃ) এর আগমন, দুই অসহায় নারীকে সাহায্য করা, হযরত শুয়াইব (আঃ) এর সাথে সাক্ষাৎ এবং তাঁর জীবনের নতুন শুরু সম্পর্কে।
মিসর থেকে পলায়ন: এক নিঃসঙ্গ যাত্রা
মৃত্যুর ভয়ে পলায়ন
কিবতি লোকটিকে হত্যার পর হযরত মূসা (আঃ) গভীর অনুশোচনায় পড়ে গিয়েছিলেন। তিনি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন এবং আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা করেছিলেন। কিন্তু মিসরের আইনের চোখে তিনি ছিলেন একজন খুনি। ফেরাউনের দরবারে তাঁর বিচার ও মৃত্যুদণ্ডের পরিকল্পনা চলছিল।
ঠিক এমন সময় এক সহানুভূতিশীল ব্যক্তি দৌড়ে এসে মূসা (আঃ) কে সতর্ক করে দিলেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন:
"আর শহরের দূর প্রান্ত থেকে এক ব্যক্তি ছুটে এসে বলল, হে মূসা! পরিষদবর্গ তোমাকে হত্যা করার পরামর্শ করছে। অতএব তুমি বের হয়ে যাও, আমি তোমার শুভাকাঙ্ক্ষীদের একজন।" (সূরা কাসাস: ২০)
এই সতর্কবাণী শুনে মূসা (আঃ) বুঝলেন যে আর কোনো বিকল্প নেই। তাঁকে মিসর ছেড়ে চলে যেতে হবে, নইলে ফেরাউনের সৈন্যরা তাঁকে ধরে ফেলবে এবং মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করবে।
ভয় আর আশার মধ্যে মরুযাত্রা
মূসা (আঃ) মিসর থেকে বের হলেন একা, কোনো পাথেয় ছাড়া, কোনো সঙ্গী ছাড়া। তাঁর গন্তব্য ছিল অজানা, পথ ছিল বিপদসংকুল। তিনি মাদইয়ানের দিকে রওনা হলেন - একটি শহর যা মিসর থেকে বহু দূরে, সিনাই উপত্যকার পূর্ব দিকে অবস্থিত।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ মূসা (আঃ) এর সেই মানসিক অবস্থা বর্ণনা করেছেন:
"অতঃপর তিনি ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় সতর্কতার সাথে সেখান থেকে বের হয়ে গেলেন। তিনি বললেন, হে আমার রব! আমাকে যালিম সম্প্রদায় থেকে রক্ষা করুন।" (সূরা কাসাস: ২১)
মূসা (আঃ) ভয়ে ছিলেন, কিন্তু তাঁর ভরসা ছিল আল্লাহর উপর। তিনি প্রতিটি পদক্ষেপে সতর্ক ছিলেন, পেছনে তাকাতেন না, শুধু এগিয়ে যেতে থাকতেন। দিনের পর দিন তিনি মরুভূমির উত্তপ্ত বালুর উপর দিয়ে হেঁটেছিলেন, রাতে আকাশের তারা দেখে পথ চিনেছিলেন।
তাঁর পায়ের চামড়া ফেটে গিয়েছিল, ক্ষুধা-তৃষ্ণায় তিনি কাতর ছিলেন। কিন্তু তবুও তিনি থেমে থাকেননি। কারণ তিনি জানতেন, মিসরে ফিরে গেলে তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত।
মাদইয়ান: আশ্রয়ের গন্তব্য
মাদইয়ান ছিল একটি প্রাচীন শহর, যা ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য পরিচিত ছিল। এখানে বসবাস করতেন হযরত শুয়াইব (আঃ) এর বংশধররা। শুয়াইব (আঃ) ছিলেন আল্লাহর একজন নবী, যিনি তাঁর সম্প্রদায়কে সৎপথে আহ্বান করেছিলেন।
মূসা (আঃ) মাদইয়ানের দিকে যাওয়ার সময় বলেছিলেন:
"আশা করি আমার রব আমাকে সঠিক পথ দেখাবেন।" (সূরা কাসাস: ২২)
এই দোয়া থেকে বোঝা যায় যে মূসা (আঃ) সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর উপর নির্ভরশীল ছিলেন। তিনি জানতেন না মাদইয়ানে তাঁর কী হবে, কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতেন যে আল্লাহ তাঁর জন্য উত্তম ব্যবস্থা করবেন।
মাদইয়ানে আগমন: কূপের পাড়ে প্রথম সাক্ষাৎ
ক্লান্ত পরিশ্রান্ত অবস্থায় মাদইয়ান পৌঁছানো
দীর্ঘ ও কষ্টকর যাত্রার পর অবশেষে মূসা (আঃ) মাদইয়ান শহরে পৌঁছলেন। তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ অপরিচিত এক ব্যক্তি - কোনো আত্মীয় নেই, কোনো পরিচিত নেই, কোনো সম্পদ নেই। তাঁর শরীর ছিল ক্লান্ত, পা ছিল ক্ষতবিক্ষত, পেট ছিল ক্ষুধার্ত।
শহরে প্রবেশ করে তিনি একটি কূপের কাছে গিয়ে থামলেন। সেখানে দেখলেন অনেক মানুষ তাদের পশুদের পানি পান করাচ্ছে। এটি ছিল একটি পাবলিক কূপ, যেখানে লোকেরা তাদের ছাগল, ভেড়া এবং উটদের পানি পান করানোর জন্য আসত।
দুই অসহায় নারীর সমস্যা
মূসা (আঃ) কূপের কাছে পৌঁছে একটি অস্বাভাবিক দৃশ্য দেখলেন। সবাই নিজেদের পশুদের পানি পান করাচ্ছে, কিন্তু দুইজন তরুণী একপাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। তাদের সাথেও কিছু পশু ছিল, কিন্তু তারা কূপের কাছে যাচ্ছিল না।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন:
"আর যখন তিনি মাদইয়ানের পানির কূপের কাছে পৌঁছলেন, তখন সেখানে একদল মানুষকে পেলেন যারা পানি পান করাচ্ছিল এবং তাদের থেকে দূরে দুইজন নারীকে পেলেন যারা তাদের পশুগুলোকে নিবৃত্ত রাখছিল।" (সূরা কাসাস: ২৩)
মূসা (আঃ) এর মধ্যে সহানুভূতির অনুভূতি জাগল। তিনি ভাবলেন, এই দুই নারী কেন একপাশে দাঁড়িয়ে আছে? কেন তারা তাদের পশুদের পানি পান করাচ্ছে না?
মূসা (আঃ) এর সদয় জিজ্ঞাসা
মূসা (আঃ) তাঁর স্বভাবসুলভ সহানুভূতি দেখিয়ে তাদের কাছে গেলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন:
"তোমাদের কী সমস্যা?"
দুই নারী সংকোচের সাথে উত্তর দিলেন:
"আমরা আমাদের পশুদের পানি পান করাতে পারি না যতক্ষণ না রাখালরা তাদের পশুদের নিয়ে চলে যায়। আর আমাদের পিতা অত্যন্ত বৃদ্ধ।" (সূরা কাসাস: ২৩)
এই উত্তর থেকে বোঝা যায় যে তাদের পিতা বৃদ্ধ এবং অসুস্থ, তাই তিনি নিজে আসতে পারছেন না। আর তারা দুই নারী হওয়ায় পুরুষদের ভিড়ের মধ্যে গিয়ে পানি নিতে সংকোচ বোধ করছিল। তারা লজ্জা ও সম্ভ্রমবোধের কারণে একপাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল যতক্ষণ না সবাই চলে যায়।
মূসা (আঃ) এর সাহায্য: মহানুভবতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত
মূসা (আঃ) তাদের কষ্ট বুঝতে পারলেন। তিনি নিজে ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত এবং তৃষ্ণার্ত থাকা সত্ত্বেও তাদের সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এটিই ছিল তাঁর চরিত্রের বিশেষত্ব - নিজের কষ্ট ভুলে অন্যের সেবা করা।
পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে:
"অতঃপর তিনি তাদের জন্য পানি তুলে দিলেন।" (সূরা কাসাস: ২৪)
মূসা (আঃ) কূপের কাছে গেলেন। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে সেই কূপের উপর একটি বিশাল পাথর ঢাকনা ছিল, যা সরাতে সাধারণত দশজন শক্তিশালী পুরুষের প্রয়োজন হতো। কিন্তু মূসা (আঃ) তাঁর শক্তি দিয়ে একাই সেই পাথর সরিয়ে ফেললেন।
তিনি কূপ থেকে পানি তুলে দুই নারীর পশুদের পানি পান করালেন। এরপর নিজে একটি গাছের ছায়ায় গিয়ে বসে পড়লেন।
আল্লাহর কাছে দোয়া: একজন মুমিনের আশ্রয়স্থল
গাছের ছায়ায় বসে মূসা (আঃ) আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন। এই দোয়াটি ছিল অত্যন্ত বিনয়ী এবং হৃদয়স্পর্শী:
"হে আমার রব! তুমি আমার প্রতি যে কল্যাণ নাজিল করবে আমি তার মুখাপেক্ষী।" (সূরা কাসাস: ২৪)
এই দোয়ায় মূসা (আঃ) কোনো নির্দিষ্ট জিনিস চাননি। তিনি শুধু বলেছেন যে তিনি আল্লাহর দেওয়া যে কোনো কল্যাণের মুখাপেক্ষী। এটি ছিল পরিপূর্ণ তাওয়াক্কুল বা আল্লাহর উপর ভরসার এক অনন্য নমুনা।
তিনি না খাবার চাইলেন, না আশ্রয় চাইলেন, না কোনো সম্পদ চাইলেন। শুধু বললেন, "হে আল্লাহ! তুমি আমার জন্য যা ভালো মনে কর, তা দাও।" এই দোয়ায় ছিল সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ এবং আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস।
হযরত শুয়াইব (আঃ) এর কন্যার আগমন
বিনয়ী ডাক
মূসা (আঃ) গাছের ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন এবং আল্লাহর জিকির করছিলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি দেখলেন যে তাঁর পানি পান করানো সেই দুই নারীর একজন লজ্জা ও সংকোচের সাথে তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন:
"অতঃপর তাদের একজন লজ্জা সহকারে তার কাছে আসল এবং বলল, আমার পিতা আপনাকে ডাকছেন, যাতে আপনার পানি পান করানোর পারিশ্রমিক তিনি আদায় করতে পারেন।" (সূরা কাসাস: ২৫)
এই দৃশ্যটি অত্যন্ত শিক্ষণীয়। মেয়েটি অত্যন্ত বিনয়ের সাথে, লজ্জা রক্ষা করে, উপযুক্ত পর্দার সাথে মূসা (আঃ) এর কাছে এসেছিল। তার কথাবার্তায় ছিল সম্মান এবং শালীনতা।
আর তার বক্তব্যও ছিল অত্যন্ত সুন্দর। সে সরাসরি ঘরে আসার আমন্ত্রণ জানায়নি, বরং বলেছে যে তার পিতা পানি পান করানোর পারিশ্রমিক দিতে চান। এটি ছিল সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার এক সুন্দর পদ্ধতি।
শুয়াইব (আঃ) এর বাড়িতে আগমন
মূসা (আঃ) সেই মেয়েটির সাথে তার বাড়িতে গেলেন। সেখানে তিনি দেখা করলেন এক বৃদ্ধ, সম্মানিত ব্যক্তির সাথে। তিনি ছিলেন হযরত শুয়াইব (আঃ) - নবী ইবরাহীম (আঃ) এর বংশধর এবং নবী সুলাইমান (আঃ) এর মতো আরেকজন আল্লাহর নবী। কিছু তাফসীরকারকদের মতে, ইনি সরাসরি শুয়াইব (আঃ) নাও হতে পারেন, বরং তাঁর কোনো পুণ্যবান বংশধর হতে পারেন। তবে অধিকাংশ মতে ইনিই ছিলেন শুয়াইব (আঃ)।
মূসা (আঃ) শুয়াইব (আঃ) এর কাছে নিজের সম্পূর্ণ ঘটনা বললেন - মিসরে কী হয়েছিল, কীভাবে তিনি অনিচ্ছাকৃতভাবে একজনকে হত্যা করে ফেলেছিলেন, কীভাবে ফেরাউন তাঁকে হত্যা করতে চাইছিল এবং কীভাবে তিনি মিসর থেকে পালিয়ে এসেছিলেন।
পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে:
"যখন তিনি তার কাছে গেলেন এবং তার ঘটনা বর্ণনা করলেন, তখন তিনি বললেন, ভয় করো না। তুমি যালিম সম্প্রদায় থেকে মুক্তি পেয়েছ।" (সূরা কাসাস: ২৫)
শুয়াইব (আঃ) মূসা (আঃ) কে সান্ত্বনা দিলেন এবং বললেন যে তিনি এখন নিরাপদ। মাদইয়ান ছিল মিসরের বাইরে, ফেরাউনের রাজত্বের অধীনে নয়। তাই এখানে তিনি সুরক্ষিত।
বিবাহের প্রস্তাব: এক সম্মানজনক চুক্তি
কন্যার সুপারিশ
শুয়াইব (আঃ) এর কন্যা তার পিতার কাছে মূসা (আঃ) কে কাজে নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ করলেন। তার কারণও ছিল অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত:
"তাদের একজন বলল, হে আমার পিতা! আপনি তাকে মজুরিতে নিয়োগ দিন। নিশ্চয়ই আপনার নিয়োগের জন্য সে-ই উত্তম যে শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত।" (সূরা কাসাস: ২৬)
এই আয়াত থেকে আমরা শিখি যে একজন কর্মচারী নিয়োগের সময় দুইটি গুণ অপরিহার্য:
১. শক্তি - কাজ করার যোগ্যতা, দক্ষতা এবং সামর্থ্য ২. বিশ্বস্ততা - সততা, আমানতদারি এবং নির্ভরযোগ্যতা
মূসা (আঃ) এর মধ্যে উভয় গুণই ছিল। তিনি শক্তিশালী ছিলেন - একাই বিশাল পাথর সরিয়ে ফেলেছিলেন। আর বিশ্বস্ত ছিলেন - যখন তিনি মেয়েটির সাথে হেঁটে আসছিলেন, তখন তিনি তাকে বলেছিলেন যে তার আগে হাঁটতে এবং পথ বাতলাতে, যাতে তিনি পেছন থেকে অনুসরণ করতে পারেন। এতে পর্দা রক্ষা হবে এবং কোনো অসঙ্গতি হবে না।
শুয়াইব (আঃ) এর প্রস্তাব
শুয়াইব (আঃ) মূসা (আঃ) এর চরিত্র, ব্যক্তিত্ব এবং আমানতদারি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে এই যুবক অসাধারণ গুণের অধিকারী। তাই তিনি তাঁকে একটি প্রস্তাব দিলেন:
"তিনি বললেন, আমি আমার এই দুই কন্যার একজনকে তোমার সাথে বিবাহ দিতে চাই এই শর্তে যে তুমি আট বছর আমার জন্য কাজ করবে। আর যদি তুমি দশ বছর পূর্ণ কর, তবে তা তোমার ইচ্ছা। আমি তোমার উপর কঠোরতা করতে চাই না। ইনশাআল্লাহ তুমি আমাকে সৎলোকদের মধ্য থেকে পাবে।" (সূরা কাসাস: ২৭)
এই প্রস্তাবে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়:
১. স্পষ্ট শর্ত: আট বছর কাজ করতে হবে, দশ বছর করলে আরও ভালো ২. নমনীয়তা: "আমি তোমার উপর কঠোরতা করতে চাই না" - এই কথায় বোঝা যায় যে তিনি একজন কোমল হৃদয়ের মানুষ ৩. আল্লাহর উপর নির্ভরতা: "ইনশাআল্লাহ" বলে তিনি আল্লাহর ইচ্ছার প্রতি সম্মান দেখিয়েছেন ৪. চরিত্রের প্রতিশ্রুতি: "তুমি আমাকে সৎলোকদের মধ্য থেকে পাবে" - তিনি নিজের সততা ও ন্যায়পরায়ণতার নিশ্চয়তা দিয়েছেন
মূসা (আঃ) এর সম্মতি
মূসা (আঃ) এই প্রস্তাবে রাজি হলেন:
"তিনি বললেন, এটা আমার ও তোমার মধ্যে স্থির হল। এই দুই মেয়াদের যেটিই আমি পূর্ণ করি, আমার উপর কোনো বাড়াবাড়ি নেই। আর আমরা যা বলছি আল্লাহ তার তত্ত্বাবধায়ক।" (সূরা কাসাস: ২৮)
মূসা (আঃ) এর এই উত্তরে রয়েছে:
- স্পষ্ট সম্মতি: তিনি চুক্তিতে রাজি হয়েছেন
- ন্যায়পরায়ণতা: আট বা দশ, যেটাই হোক, কোনো অবিচার হবে না
- আল্লাহকে সাক্ষী রাখা: আল্লাহই সাক্ষী এই চুক্তির
এইভাবে মূসা (আঃ) এর বিবাহ সম্পন্ন হল এবং তিনি শুয়াইব (আঃ) এর জামাতা হলেন। এটি ছিল এক সম্মানজনক চুক্তি, যেখানে উভয় পক্ষই নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন ছিল।
মাদইয়ানে নতুন জীবন: পরিবার ও দায়িত্ব
রাখাল হিসেবে জীবনযাপন
মূসা (আঃ) শুয়াইব (আঃ) এর কন্যাকে বিবাহ করার পর রাখাল হিসেবে কাজ শুরু করলেন। যিনি একসময় মিসরের রাজপ্রাসাদে বড় হয়েছিলেন, পাওয়া যেত সর্বোত্তম শিক্ষা, পরিধান করতেন রাজকীয় পোশাক, তিনিই এখন মরুভূমিতে পশু চরাচ্ছেন।
কিন্তু মূসা (আঃ) কোনো অভিযোগ করলেন না, কোনো অসন্তোষ প্রকাশ করলেন না। তিনি বিনয়ের সাথে, আন্তরিকতার সাথে এই দায়িত্ব পালন করতে লাগলেন। এই সময়টি ছিল তাঁর জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণকাল।
মরুজীবনের শিক্ষা
মাদইয়ানে বসবাসের সময় মূসা (আঃ) অনেক কিছু শিখলেন:
সহনশীলতা ও ধৈর্য: রাখালের জীবন সহজ ছিল না। প্রখর রোদে, ঝড়ঝঞ্ঝায়, রাতের শীতে তাঁকে পশুদের দেখাশোনা করতে হতো। এই অভিজ্ঞতা তাঁকে ধৈর্যশীল করে তুলল।
মরুভূমির পথঘাট: তিনি মরুভূমির প্রতিটি পথ, প্রতিটি ঝর্ণা, প্রতিটি আশ্রয়স্থল চিনে ফেললেন। এই জ্ঞান পরবর্তীতে বনী ইসরাঈলকে মিসর থেকে বের করার সময় অত্যন্ত কাজে লেগেছিল।
নেতৃত্বের গুণ: পশুপাল পরিচালনা করতে গিয়ে তিনি নেতৃত্ব দেওয়ার শিক্ষা পেলেন - কীভাবে দায়িত্ব নিতে হয়, কীভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, কীভাবে সবাইকে সাথে নিয়ে চলতে হয়।
বিনয় ও নম্রতা: প্রাসাদের জীবন থেকে রাখালের জীবনে আসা তাঁকে বিনয়ী করে তুলল। তিনি বুঝলেন যে মানুষের মর্যাদা তার সম্পদে নয়, বরং তার চরিত্রে।
আল্লাহর সাথে সম্পর্ক: মরুভূমির নির্জনতায়, রাতের আকাশের নিচে, তিনি আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে তুললেন। ইবাদত, জিকির, ধ্যান - এসব তাঁর নিত্যদিনের অভ্যাসে পরিণত হল।
পারিবারিক জীবন: সুখ ও শান্তি
মূসা (আঃ) এর পারিবারিক জীবন ছিল অত্যন্ত সুখের। তাঁর স্ত্রী ছিলেন পূণ্যবতী, ভদ্র ও চরিত্রবান। শুয়াইব (আঃ) ছিলেন একজন আদর্শ শ্বশুর, যিনি মূসা (আঃ) কে পুত্রের মতো ভালোবাসতেন এবং সম্মান করতেন।
এই সময়ে মূসা (আঃ) এর সন্তান হয়েছিল। কিছু বর্ণনা অনুযায়ী তাঁর দুইজন ছেলে ছিল - গেরশোম এবং ইলিয়েজার।
মাদইয়ানে কাটানো এই বছরগুলো ছিল মূসা (আঃ) এর জীবনের সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ সময়। কোনো দুশ্চিন্তা নেই, কোনো ভয় নেই, কোনো রাজনৈতিক চক্রান্ত নেই। শুধু সহজ-সরল জীবন, পরিবার এবং আল্লাহর ইবাদত।
চুক্তি পূর্ণ হওয়া: ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত
দশ বছর পূর্ণ করা
মূসা (আঃ) তাঁর চুক্তি পূর্ণ করলেন। তিনি শুধু আট বছরই নয়, বরং পূর্ণ দশ বছর শুয়াইব (আঃ) এর সেবা করলেন। এটি ছিল তাঁর সততা ও প্রতিশ্রুতি রক্ষার এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেন: "মূসা (আঃ) পূর্ণ মেয়াদ এবং সবচেয়ে ভালো মেয়াদ সম্পন্ন করেছিলেন।" অর্থাৎ তিনি দশ বছর পূর্ণ করেছিলেন এবং সেই সময়ে সর্বোত্তম সেবা করেছিলেন।
মিসরে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত
দশ বছর পর মূসা (আঃ) সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি তাঁর পরিবারকে নিয়ে মিসরে ফিরে যাবেন। কেন তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন?
কারণগুলো হতে পারে:
- তাঁর মা ও ভাই হারুন (আঃ) এর সাথে দেখা করার আকাঙ্ক্ষা
- দীর্ঘ সময় পর মিসরে পরিস্থিতি কেমন তা দেখা
- সম্ভবত ফেরাউন বা তার কর্মকর্তারা বিষয়টি ভুলে গেছে বা ক্ষমা করে দিয়েছে
তবে আল্লাহর পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন। মূসা (আঃ) জানতেন না যে এই যাত্রায় তিনি নবুওয়াত লাভ করবেন এবং তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব শুরু হবে।
পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে:
"অতঃপর যখন মূসা মেয়াদ পূর্ণ করল এবং তার পরিবার-পরিজন নিয়ে রওনা হল..." (সূরা কাসাস: ২৯)
এই আয়াত থেকে বোঝা যায় যে মূসা (আঃ) তাঁর চুক্তি সম্পূর্ণ করার পরই মাদইয়ান ত্যাগ করেছিলেন। তিনি একজন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ মানুষ ছিলেন।
মাদইয়ান জীবন থেকে শিক্ষা ও উপদেশ
আল্লাহর পরিকল্পনা সর্বোত্তম
মূসা (আঃ) মিসর থেকে পালিয়ে এসেছিলেন ভয়ে, অনিশ্চয়তায়। কিন্তু আল্লাহ তাঁর জন্য এমন ব্যবস্থা করলেন যা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি:
- নিরাপদ আশ্রয়
- সম্মানজনক বিবাহ
- পূণ্যবান শ্বশুর
- শান্তিপূর্ণ জীবন
- নবুওয়াতের প্রস্তুতি
এটি আমাদের শেখায় যে আল্লাহর পরিকল্পনা আমাদের কল্পনার চেয়ে সবসময় উত্তম। কখনো কখনো যা আমরা বিপদ মনে করি, তা হয়তো আল্লাহর রহমত।
পরীক্ষার মাধ্যমে উন্নতি
মূসা (আঃ) এর জীবন আমাদের দেখায় যে পরীক্ষা মানুষকে শক্তিশালী করে। প্রাসাদের জীবন থেকে রাখালের জীবনে আসা - এটি একটি বড় পরীক্ষা ছিল। কিন্তু এই পরীক্ষাই তাঁকে প্রস্তুত করল মহান নবী হওয়ার জন্য।
আল্লাহ বলেন:
"মানুষ কি মনে করে যে তারা শুধু এই বলেই ছেড়ে দেওয়া হবে যে 'আমরা ঈমান এনেছি', আর তাদের পরীক্ষা করা হবে না?" (সূরা আনকাবুত: ২-৩)
নম্রতা ও বিনয়ের গুরুত্ব
মূসা (আঃ) রাজপ্রাসাদে বড় হওয়া সত্ত্বেও অত্যন্ত নম্র ছিলেন। তিনি:
- দুই অসহায় নারীকে সাহায্য করলেন
- রাখালের কাজ করতে লজ্জা পেলেন না
- শ্বশুরের সেবা করলেন আন্তরিকতার সাথে
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন: "যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য বিনয় অবলম্বন করে, আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করেন।"
কঠোর পরিশ্রম ও সততা
মূসা (আঃ) তাঁর চুক্তি পূর্ণ করলেন সততার সাথে। তিনি শুধু আট বছরই নয়, পূর্ণ দশ বছর সেবা করলেন। এটি আমাদের শেখায় যে:
- প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা জরুরি
- কাজে আন্তরিকতা থাকতে হবে
- যেকোনো হালাল পেশা সম্মানজনক
পর্দা ও লজ্জাশীলতা
শুয়াইব (আঃ) এর কন্যাদের আচরণ থেকে আমরা শিখি:
- নারীরা বাইরে কাজ করতে পারে প্রয়োজনে
- কিন্তু পর্দা ও লজ্জা রক্ষা করা জরুরি
- পুরুষদের সাথে কথা বলতে হলে সম্মান ও শালীনতা রক্ষা করতে হবে
কুরআনে বলা হয়েছে যে তারা "লজ্জা সহকারে" মূসা (আঃ) এর কাছে এসেছিল। এটি একটি আদর্শ মুসলিম নারীর বৈশিষ্ট্য।
দোয়ার শক্তি
মূসা (আঃ) যখন গাছের ছায়ায় বসে দোয়া করলেন, আল্লাহ তাৎক্ষণিক তার দোয়া কবুল করলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর জীবনে বিরাট পরিবর্তন এলো।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন: "দোয়া মুমিনের অস্ত্র।" যখন আমরা বিপদে পড়ি, আল্লাহর কাছে দোয়া করা উচিত বিনয়ের সাথে, আন্তরিকতার সাথে।
উপসংহার: পরবর্তী অধ্যায়ের দিকে
মাদইয়ানে কাটানো দশ বছর ছিল মূসা (আঃ) এর জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময়ে তিনি:
- একজন রাজকুমার থেকে একজন নম্র রাখালে পরিণত হলেন
- পারিবারিক জীবনের সুখ লাভ করলেন
- মরুভূমি এবং তার পথঘাট সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান অর্জন করলেন
- নেতৃত্ব, ধৈর্য, এবং দায়িত্বশীলতার শিক্ষা পেলেন
- আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক তৈরি করলেন
এই সবকিছুই ছিল তাঁর নবুওয়াতের প্রস্তুতি। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে এমন এক দায়িত্ব দিতে যাচ্ছিলেন যা ইতিহাসের অন্যতম কঠিন দায়িত্ব - ফেরাউনের সামনে দাঁড়িয়ে সত্যের বাণী প্রচার করা এবং বনী ইসরাঈলকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করা।
মাদইয়ান ত্যাগ করার পর মূসা (আঃ) এর জীবনে এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল। তূর পর্বতের কাছে তিনি আল্লাহর সাথে কথা বলবেন, নবুওয়াত লাভ করবেন, এবং ফেরাউনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য নির্দেশ পাবেন।
পরবর্তী পর্বে আমরা জানব সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের কথা - যখন মূসা (আঃ) আগুন খুঁজতে গিয়ে পেলেন আল্লাহর সান্নিধ্য, যখন তিনি দেখলেন জ্বলন্ত ঝোপ যা পুড়ে ছাই হয় না, যখন তিনি শুনলেন আল্লাহর ডাক: "নিশ্চয়ই আমি তোমার রব!"
চলবে...
পাঠকদের জন্য চিন্তা-ভাবনা
১. মূসা (আঃ) অপরিচিত দুই নারীকে সাহায্য করেছিলেন নিজের কষ্ট সত্ত্বেও। আমরা কি অন্যদের সাহায্য করার সময় আমাদের নিজের সুবিধার কথা বেশি ভাবি?
২. শুয়াইব (আঃ) মূসা (আঃ) কে বিচার করেছিলেন তাঁর বর্তমান চরিত্রের ভিত্তিতে, অতীতের ভুলের ভিত্তিতে নয়। আমরা কি মানুষকে দ্বিতীয় সুযোগ দিতে প্রস্তুত?
৩. মূসা (আঃ) প্রাসাদের জীবন থেকে রাখালের জীবনে এসেও অভিযোগ করেননি। আমরা কি আমাদের পরিস্থিতিতে সন্তুষ্ট থাকতে পারি?
৪. তাঁর দোয়া ছিল সংক্ষিপ্ত কিন্তু আন্তরিক। আমাদের দোয়ায় কি এই আন্তরিকতা আছে?
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে মূসা (আঃ) এর জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়ার তাওফিক দান করুন। আমীন।
_%E0%A6%8F%E0%A6%B0_%E0%A6%9C%E0%A7%80%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A6%95%E0%A6%A5%E0%A6%BE_%E0%A6%AA%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AC_%E0%A7%AC.jpeg)
Please do not enter any spam link in the comment box. ConversionConversion EmoticonEmoticon